নতুন শিক্ষাক্রম: ইংরেজি মাধ্যমে ঝোঁক এবং শিক্ষার বেসরকারীকরণ বাড়বে


 ২০২৪ সালের শিক্ষাবর্ষের জন্য স্কুলে ভর্তির পরিসংখ্যানে এটা স্পষ্ট হচ্ছে, বাংলা মাধ্যম কিন্ডারগার্টেন থেকে অধিক হারে শিশুদের ব্রিটিশ কারিকুলাম স্কুলে সরিয়ে নিচ্ছেন অভিভাবকেরা। নতুন শিক্ষাক্রমের অনিশ্চয়তা অধিকসংখ্যক শহুরে শিক্ষার্থী ইংরেজি মাধ্যমে চলে যাবে।

নতুন শিক্ষাক্রম দিয়ে সরকার আসলে শিক্ষাকে বেসরকারীকরণের গতি বাড়িয়েছে। কেননা, শিক্ষায় বরাদ্দ বাড়াতে চায় না সরকার। একটা সময় আসছে, যখন এ দেশের মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানেরাও বিদেশে পাড়ি জমাবে স্কুল-কলেজে পড়ার জন্য। সাধারণ মানুষ চান তাঁর সন্তানদের সুন্দর ভবিষ্যৎ।

বাংলা মাধ্যমের সাধারণ কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ালেখার সঙ্গে দক্ষতা ও চাকরির সুযোগ কমে গেছে। এতে মানুষ আগ্রহ ও আস্থা হারাচ্ছেন।

বাংলা মাধ্যমে মানুষ নতুনভাবে আরেক দফা আগ্রহ হারালে একদিকে সচ্ছল পরিবারের সন্তানেরা যেমন ইংরেজি মাধ্যমে কিংবা বিদেশে পাড়ি দেবে, তেমনি সাধারণ কিংবা গরিবের সন্তানেরা মাদ্রাসায় যাবে।


বাস্তবে শিক্ষার খরচের ভয়ে মানুষ সাশ্রয়ী শিক্ষার বিকল্প হিসেবে খুঁজে পাচ্ছেন মাদ্রাসাশিক্ষা। শিক্ষা ভবিষ্যতে আয় তৈরির পথ নিশ্চিত করে বলে দারিদ্র্য বিমোচনের প্রধানতম হাতিয়ার। অথচ শিক্ষা খরচের ঋণ ও দরিদ্র হওয়ার ভয়েই মানুষ সন্তানকে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পাঠাতে ভয় পাচ্ছেন। এখনো এসএসসি ও এইচএসসির ফরমের টাকাটা সরকার ফ্রি করেনি। গ্রামে মানুষকে ধার করে, ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে এই টাকা জোগাড় করা লাগে।

একটি আধুনিক কল্যাণ রাষ্ট্রে উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত ভর্তি, বই, পরীক্ষার ফি, যাতায়াত, কোচিং, ট্রেনিং—শিক্ষার এসব ক্ষেত্রের সব খরচ সরকারের বহন করার কথা। স্কুল ও কলেজে শিক্ষার সমুদয় ব্যয় নির্বাহে সরকারের দায়মোচন হয়নি, হয়নি মানুষের শিক্ষার মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠা।

২০২২ সালে একটা স্টাডি করেছি। কুমিল্লায় একটি ভালো মানের গার্লস স্কুল ও কলেজের অধ্যক্ষ রেজিস্ট্রার খাতা খুলে আমাকে দেখিয়েছেন। স্কুলটিতে গড়ে ২০২১-২২ সালে ৬ শতাংশ শিক্ষার্থী কমেছে। তথ্য যাচাই করতে পাশের গ্রামের দাখিল মাদ্রাসার (শুধু মানবিক বিভাগ আছে) অধ্যক্ষকে শিক্ষার্থী ভর্তি সংখ্যার বৃদ্ধি দেখাতে বললে তিনি দেখিয়েছেন প্রায় ৮ শতাংশ ভর্তি বেড়েছে।


গ্রামে ও শহরে বাংলা মাধ্যমের স্কুলশিক্ষা সংকোচনের সঙ্গে যেসব আর্থসামাজিক বাস্তবতা জড়িত, সেগুলোকে আমলে নিতে হবে। গ্রামে অধিক হারে শিক্ষার্থী মাদ্রাসায় যাচ্ছে, শহরে যাবে ইংরেজি মাধ্যমে।

শহরের নিম্নমধ্যবিত্ত ও বস্তিবাসী সবচেয়ে বেশি ভোগান্তির হচ্ছেন। এমনিতেই নিম্নবিত্তের জনপরিসরে এ ধারণা গেঁথে গেছে, সাধারণ মানের শিক্ষা চাকরির নিশ্চয়তা দেয় না বলে স্কুল-কলেজে গিয়ে কোনো লাভ নেই।

যেহেতু দাখিলও নতুন কারিকুলামের আওতাধীন, তাই তামিরুল মিল্লাতের মতো যেসব মাদ্রাসা অনেক ভালো করছিল, তারাও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ইংরেজি আর কওমিতে একচেটিয়া শিক্ষার্থী বাড়বে। যাঁদের সামর্থ্য আছে, তাঁরা ইংরেজি মাধ্যমের স্কুল খোঁজ করছেন, যাতে সামনের বছর সন্তানকে দিতে পারেন সেখানে। আর যাঁদের সামর্থ্য নেই, তাঁরা বিপদের মধ্যে পড়ছেন।

আমাদের বাংলা মাধ্যমের স্কুলশিক্ষার প্রতিষ্ঠিত পথটি ব্যর্থ হতে যাচ্ছে, এটা হতাশার। ক্রমাগত পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছেই, যেমন জিপিএ গ্রেডিং সিস্টেমে পরিবর্তন, প্রাইমারি-নিম্নমাধ্যমিকে পাবলিক পরীক্ষা একবার ঢোকানো আবার বন্ধ করা, সৃজনশীল ঢুকিয়ে পরে বন্ধ করা, শিক্ষক প্রস্তুত না করেই সৃজনশীল সিলেবাস ঢোকানো। বিশেষ দলের বুদ্ধিবৃত্তিক তৎপরতায় যুক্ত দু-চারজন লেখক দিয়েই গণিত, পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন, উচ্চতর গণিত ও জীববিজ্ঞানের সব বই লেখানো। এসএসসিতে অটো পাস, আবার এসএসসি বন্ধের উদ্যোগ, এইচএসসিতে অটো পাস, সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে পরীক্ষা, সহজ প্রশ্ন, বেশি পাস দেখাতে উদার মূল্যায়ন—এসবের পাশাপাশি প্রশ্ন ফাঁসের মতো ধারাবাহিক জঞ্জাল তো আছেই!

এসব কারণে বাংলা মাধ্যমের শিক্ষার বারোটা বেজে গেছে। এ শিক্ষা শিক্ষিত বেকার ছাড়া কিছুই দিচ্ছে না। নতুন কারিকুলাম এই পরিস্থিতিকে আরও শোচনীয় করতে পারে।


উন্নত বিশ্বে ধারাবাহিক শিক্ষক মূল্যায়ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সেখানে বই আকারের প্রশ্নপত্রগুলো আঞ্চলিক শিক্ষা বোর্ড থেকে পাঠানো হয়। পরীক্ষার পর নম্বর সফটওয়্যারে ইনপুট দিয়ে উত্তরপত্র বোর্ড অফিসে ফেরত পাঠানো হয়, যা আবার দৈবচয়নের ভিত্তিতে নিরীক্ষায় পড়ে।

বাংলাদেশে শিক্ষক না বাড়িয়ে, শিক্ষকের শ্রমঘণ্টার হিসাব না করে, কারিগরি সফটওয়্যার ও কম্পিউটারভিত্তিক অবকাঠামোগত বন্দোবস্ত না করে ফিনল্যান্ডের কারিকুলামের কথা বলে একটা কারিকুলাম চালিয়ে দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হলো।

‘এক্সপেরিমেন্টাল লার্নিং’য়ের কথা বলা হয়েছে, অথচ এর জন্য দরকার এক্সট্রা কারিকুলাম ডিজাইন এবং বিশেষ দক্ষ জনবল। এক্সপেরিমেন্টাল লার্নিংয়ের নাম করে আসলে একটা ‘আনটেস্টেড এক্সপেরিমেন্টাল কারিকুলাম’ কতটা কাজে দেবে?

একটা স্কুল কারিকুলামের মূল লক্ষ্য হচ্ছে, ভাষা ও গণিত ভালোভাবে শেখানো। এই দুটি ভালো হলে অপরাপর বিষয়ে শিক্ষার্থীরা এমনিতেই ভালো করবে। তবে সবাইকে সব বিষয়ে খুব ভালো হতে হবে, এমন আশা করা উচিত নয়।

শিক্ষার্থীর লেখা, বলা, উপস্থাপনা, যোগাযোগ ইত্যাদি স্কিলের উন্নয়ন করা এবং তার সামাজিক বিকাশের দায়িত্বও স্কুলের। এর জন্য দরকার শিক্ষকের ‘ইনটেনসিভ কেয়ার’, উচ্চ মানের শিক্ষক ও সফটওয়্যারভিত্তিক শিক্ষণ এবং পর্যাপ্তসংখ্যক শিক্ষক।

উন্নত বিশ্বে ধারাবাহিক শিক্ষক মূল্যায়ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সেখানে বই আকারের প্রশ্নপত্রগুলো আঞ্চলিক শিক্ষা বোর্ড থেকে পাঠানো হয়। পরীক্ষার পর নম্বর সফটওয়্যারে ইনপুট দিয়ে উত্তরপত্র বোর্ড অফিসে ফেরত পাঠানো হয়, যা আবার দৈবচয়নের ভিত্তিতে নিরীক্ষায় পড়ে।

বাংলাদেশে শিক্ষক না বাড়িয়ে, শিক্ষকের শ্রমঘণ্টার হিসাব না করে, কারিগরি সফটওয়্যার ও কম্পিউটারভিত্তিক অবকাঠামোগত বন্দোবস্ত না করে ফিনল্যান্ডের কারিকুলামের কথা বলে একটা কারিকুলাম চালিয়ে দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হলো।

‘এক্সপেরিমেন্টাল লার্নিং’য়ের কথা বলা হয়েছে, অথচ এর জন্য দরকার এক্সট্রা কারিকুলাম ডিজাইন এবং বিশেষ দক্ষ জনবল। এক্সপেরিমেন্টাল লার্নিংয়ের নাম করে আসলে একটা ‘আনটেস্টেড এক্সপেরিমেন্টাল কারিকুলাম’ কতটা কাজে দেবে?

একটা স্কুল কারিকুলামের মূল লক্ষ্য হচ্ছে, ভাষা ও গণিত ভালোভাবে শেখানো। এই দুটি ভালো হলে অপরাপর বিষয়ে শিক্ষার্থীরা এমনিতেই ভালো করবে। তবে সবাইকে সব বিষয়ে খুব ভালো হতে হবে, এমন আশা করা উচিত নয়।

শিক্ষার্থীর লেখা, বলা, উপস্থাপনা, যোগাযোগ ইত্যাদি স্কিলের উন্নয়ন করা এবং তার সামাজিক বিকাশের দায়িত্বও স্কুলের। এর জন্য দরকার শিক্ষকের ‘ইনটেনসিভ কেয়ার’, উচ্চ মানের শিক্ষক ও সফটওয়্যারভিত্তিক শিক্ষণ এবং পর্যাপ্তসংখ্যক শিক্ষক।

No comments

Powered by Blogger.